চাকরি খোয়ালেন সাকলায়েন

ঢাকা বোটক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগ এনে ২০২১ সালে  মামলা করেন হালের আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনি। ওই মামলার তদন্ত করে ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগ। তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পান তৎকালীন ডিবি গুলশান বিভাগের এডিসি গোলাম সাকলায়েন। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বাদী পরীমনির সঙ্গে পরিচয় হয় সাকলায়েনের। তবে সেই সম্পর্ক বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সম্পর্কের মধ্যে থাকেনি। ঘন ঘনই পরীমনিকে তার কার্যালয়ে ডেকে নিতেন সাকলায়েন। এভাবে কিছুদিনের মাথায় তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্ক হয়। তারপর থেকে তারা নিয়মিত কথা বলা, দেখা করা শুরু করেন। দুজনের মধ্যে বাড়তে থাকে সখ্যতা। একসময় সেটি অন্তরঙ্গ সম্পর্কে গড়ায়।

দিনে-রাতের অধিকাংশ সময় তারা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতেন। নামিদামি রেস্টুরেন্টে যাওয়া-আসা করতেন। রাতভর মোবাইল ফোন, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতেন। সাকলায়েন পরীমনির বাসায় নিয়মিত রাত্রীযাপন করতেন। পরীমনিও সাকলায়েনের রাজারবাগ মধুমতি পুলিশ অফিসার্স কোয়ার্টারে আসতেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হয়ে বাদীর সঙ্গে এরকম অবাধ মেলামেশা এবং বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ককে অনেকেই ভালোভাবে নেননি। বিশেষ করে স্ত্রীর অনুপস্থিতে সরকারি কোয়ার্টারে পরীমনিকে এনে তার সঙ্গে একই বাসায় ১৭ ঘণ্টা থাকা ও পরীমনির সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জন্মদিন পালনের বিষয়টি অনেকের চোখ এড়ায়নি। সাকলায়েনের সঙ্গে সরকারি কোয়ার্টারে পরীমনির প্রবেশ ও খোলামেলা জন্মদিন পালনের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিষয়টি জানাজানি হয়। গুলশান বিভাগ থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রথমে তাকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) বদলি করা হয়। পরে তাকে ঝিনাইদহ ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি দীর্ঘদিন তদন্ত করে পরীমনির সঙ্গে সাকলায়েনের অনৈতিক সম্পর্কের সত্যতা পায়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১৩ই জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-২ শাখা থেকে উপসচিব রোকেয়া পারভিন জুঁই স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে গুরুদণ্ড হিসেবে সাকলায়েনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর জন্য পিএসসির কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের এডিসি থাকাকালে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে পরিচয়, যোগাযোগ শুরু হয় গোলাম সাকলায়েনের। তিনি নায়িকা পরীমনির বাসায় নিয়মিত রাত্রিযাপন করতে শুরু করেন। পুলিশ অধিদপ্তরের এলআইসি শাখা থেকে দেয়া ফোনের সিডিআর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৪ঠা জুলাই থেকে ৪ঠা আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে (দিনে ও রাতে) নায়িকা পরীমনির বাসায় অবস্থান করেছেন তৎকালীন ডিবির এই কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের ১লা আগস্ট ভোর ৬টা থেকে ২রা আগস্ট রাত ৩টা পর্যন্ত রাজারবাগ মধুমতি পুলিশ অফিসার্স কোয়ার্টার্সে পরীমনির যাতায়াতের ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজের ফরেনসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে জানা যায়, ১লা আগস্ট সাকলায়েনের পূর্ব পরিকল্পনা ও তার স্ত্রী না থাকা অবস্থায় পরীমনি তার রাজারবাগের সরকারি বাসায় যান। সেখানে প্রায় ১৭ ঘণ্টা অবস্থান করে ২রা আগস্ট রাত ১টা ৩০ মিনিটে বাসা ত্যাগ করেন। এ ছাড়া পরীমনি মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়,  ২৯শে জুলাই ২০২১ থেকে  ৩রা আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত সাকলায়েন ও পরীমনির ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপে আদান প্রদান করা মেসেজ ও কথাবার্তা সাধারণ পরিচিতি বা পেশাগত প্রয়োজনের কোনো সম্পর্কের জন্য নয়। এসব মেসেজ ও কথাবার্তা অনৈতিক সম্পর্কের। 

প্রতিবেদনে  আরও বলা হয়, সাকলায়েন ও পরীমনির সম্পর্কের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম দেয়। সাকলায়েন বাংলাদেশ পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে সরকারি দায়িত্বের বাইরে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সাকলায়েন বিবাহিত ও এক সন্তানের বাবা হওয়া সত্ত্বেও পরীমনির সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পরীমনির সঙ্গে জন্মদিন উদ্‌যাপন ও নিজের সরকারি বাসভবনে নিজ স্ত্রীর অবর্তমানে সময় কাটানোর মতো ঘটনা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লিখিত অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সাক্ষীদের জবানবন্দি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক লিখিত জবাব, মৌখিক বক্তব্য ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি পুনরায় বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক পর্যালোচনার পর ২য় কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ?‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনকে বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধি মোতাবেক ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে চাকরি থেকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান’-এর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

মানবজমিন থেকে সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *